কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে তাণ্ডবে সম্পৃক্ততার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ অন্যান্য সব অঙ্গ সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী সত্তা’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালের সন্ত্রাস বিরোধী আইনে নির্বাহী আদেশে এই সংগঠন দুটিকে নিষিদ্ধ করেছে। ফলে এই দুই সংগঠন ও এর সব অঙ্গ সংগঠন ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে গণ্য হবে।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ (১) ধারার ক্ষমতা বলে সরকার নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও তাদের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করেছে।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ওই ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার যুক্তিসঙ্গ কারণ থাকলে সরকার প্রজ্ঞাপন দিয়ে ওই ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে পারবে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে পারবে। এখানে ‘সত্তা’ বলতে কোনো আইনি প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, বাণিজ্যিক বা অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী, অংশীদারী কারবার, সমবায় সমিতিসহ এক বা একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত যেকোনো সংগঠনকে বোঝায়।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী, ‘সত্তা’ বলতে কোনো আইনি প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, বাণিজ্যিক বা অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী, অংশীদারি কারবার, সমবায় সমিতিসহ এক বা একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত যেকোনো সংগঠনকে বোঝায়।
সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর থেকে এবার নিয়ে দলটি চারবার নিষিদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে অন্য তিনটি ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়েছিল। পরে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ২৫ মে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায় জামায়াত। দলটির ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘও নাম পরিবর্তন করে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে আত্মপ্রকাশ করে।
জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্ব নাম জামায়াত-ই-ইসলামী, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং এর অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে (পূর্ব নাম ইসলামী ছাত্রসংঘ) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ ছাড়া এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। আপিল বিভাগ ওই রায় বহাল রেখেছেন।
এর আগে গত ২৬ জুলাই ১৪ দলের বৈঠকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও দলটির অঙ্গসংগঠন ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নেওয়া হয়। ওইদিন রাতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে অনুষ্ঠিত ১৪ দলের বৈঠকে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
১৪ দল মনে করে, সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে যে সন্ত্রাস এবং নাশকতা হয়েছে এর পিছনে জামায়াত-শিবির কলকাঠি নেড়েছে। ১৭ জুলাই থেকে ঢাকায় যে সন্ত্রাসী তাণ্ডব হয়েছে এর মূল কারিগর ছিল জামায়াত-শিবির।
বৈঠকে ১৪ দলের নেতারা অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, জামায়াত-শিবির সন্ত্রাসী সংগঠন, যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলটির শীর্ষ নেতাদের বিচার হয়েছে। এছাড়া সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নির্বাচন কমিশন যেহেতু জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে সেজন্য এখন আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সময় এসেছে। কারণ একাত্তরের স্বাধীনতা বিরোধী যে চরিত্র তা এখনো বদলায়নি।
বৈঠকে ১৪ দলের নেতারা জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মতি দেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব ১৪ দলের বৈঠকে পাস হয়।
উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনলে ৩৮টি দলের সঙ্গে সংসদে প্রতিনিধিত্ব থাকা জামায়াতে ইসলামীও নিবন্ধিত হয়। আইন অনুযায়ী শুধু নিবন্ধিত দলগুলোই নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।
এরপর তরিকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে জামায়াতকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন।
ওই রিটের প্রেক্ষিতে জারি করা রুলের শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের বেঞ্চ জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রায় দেন। রায়ে সংবিধানের সঙ্গে দলটির গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয়।
এরপর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে, যা গত বছরের ১৯ নভেম্বর খারিজ হয়ে যায়।