বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের বাংলাদেশের সংসদ সদস্য ছিলেন আনোয়ারুল আজিম অনার । কলকাতায় নিখোঁজ হয়ে হত্যার ঘটনাটি এখন একটি জটিল রহস্যে পরিণত হয়েছে।
ভারতে প্রবেশ (১২ই মে ২০২৪)
আনোয়ারুল ১২ই মে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আসেন । তার নিয়মিত বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় যাতায়াত ছিল। কলকাতায় ওনার এক পারিবারিক বন্ধু ছিলেন, যার নাম গোপাল বিশ্বাস। তিনি গোপাল বিশ্বাসের সাথে দেখা করতে কলকাতার নিউটাউনের ফ্ল্যাটে যান।
নিখোঁজ হওয়া (১৩ই মে ২০২৪)
১৩ই মে সকাল বেলা তিনি একজন চিকিৎসককে দেখানোর জন্য গোপালের বাড়ি থেকে বের হন। তিনি বলেন দিল্লি যাবেন এবং সেখানে ভিআইপিদের সাথে দেখা করবেন। সেই দিন সন্ধ্যায় গোপালকে জানান যে তিনি দিল্লি পৌঁছে গেছেন এবং তাকে ফোন করতে নিষেধ করেন।
নিখোঁজ ডায়রি ১ (১৪ই মে- ২০২৪ )
১৪ই মে থেকে তার ফোন বন্ধ থাকে, এরপর আনোয়ারুলের মেয়ে বাংলাদেশের পুলিশের কাছে নিখোঁজ হওয়ার একটি ডায়েরি করেন এবং পুরো বিষয়টি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানানো হয় ,তারপরেই তার দপ্তরে থেকে দিল্লি ও কলকাতায় কূটনৈতিক ভবন ও ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগকে বিষয়টি জানান।
নিখোঁজ ডায়েরি ২ (১৮ই মে ২০২৪)
১৪ই মে থেকে গোপাল বিশ্বাস বন্ধুর সাথে বারংবার যোগাযোগে ব্যর্থ হওয়ায় কলকাতার বরাহনগর থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন।
পুলিশি তদন্ত (১৮ই মে এর পর)
বরাহনগর থানার পুলিশ গোপালের নিখোঁজ ডায়েরি নথিভুক্ত করার পর থেকেই সাংসদের খোঁজ চালানো হয় । পুলিশ নিউটাউন এলাকার নানান জায়গার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সাংসদের খোঁজ শুরু করেন ,তাতে দেখা যায় তিনি ওই এলাকার একটি স্কুলের কাছ থেকে একটি গাড়ি বুক করেন । পুলিশ সেই গাড়ির চালক ও মালিকের সঙ্গেও কথা বলেন এবং তাতে জানা যায় নিউটনের বাসস্ট্যান্ডে তাকে নামানো হয় । বরাহনগর পুলিশ সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজ থেকে জানতে পারি যে সাংসদ দ্বিতীয় একটি গাড়িতে চেপেছিলেন , তার সাথে সেই গাড়িতে একজন মহিলা ও একজন পুরুষও ছিল। নিউটাউন এর একটি আবাসনে তাদের ঢুকতে দেখা যায়।
মৃতদেহের খোঁজ চালানো (২২শে মে ২০২৪)
ইতিমধ্যেই সংসদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। কলকাতা নিউটাউনে অ্যাকোয়াটিকার পাশে ওই আবাসনে ব্যারাকপুর ও বিধান নগর কমিশনারেটের পুলিশ ওখানে পৌঁছায়। সিসিটিভি ফুটেজ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে তা নিয়ে তদন্ত চলে।। ফ্ল্যাটের ভিতরে লালচে দাগ ও দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায় সেই দিন যারা সাংসদের সাথে ভেতরে যায় তারা বিভিন্ন দিনে ওই ফ্ল্যাট থেকে বের হন এবং তাদের হাতে বড় বড় ট্রলি ব্যাগও ছিল । অনুমান করা হয়েছে যে সাংসদকে খুন করে তার দেহ টুকরো করে ওই ট্রলি ব্যাগে ভরে পাচার করা হয়েছে।
গ্রেফতার ও তদন্ত
তদন্তে উঠে এসেছে যে ,আনোয়ারুলকে খুন করিয়েছিলেন তার বাল্যবন্ধু আখতারুজ্জামান ওরফে শাহীন। খুনের জন্য মুম্বাই থেকে জিহাদ হাওলদার নামক এক কসাইকে আনা হয়। আখতারুজ্জামান একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত আমেরিকান নাগরিক । বনগাঁ এলাকা থেকে জাহিদকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাজ ছিল খুনিদের সহায়তা করা এবং দেহাংশ লুকিয়ে রাখা ।পুলিশের তরফ থেকে জানানো হয় জেরায় জিহাদ শিকার করে যে আজিমকে প্রথমে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। জিহাদ সহ পাঁচজন মিলে এই কাজ করেছিল বলে জানা যায় পুলিশ সূত্রে,সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশের পুলিশ আমানুল্লা আমান , শিলাস্তি রহমান এবং ফয়সাল আলী নামক তিন খুনিকে গ্রেফতার করে। এখনো পর্যন্ত জিহাদের দুই সঙ্গি মোস্তাফিজুর ও সিয়ামের খোঁজ মেলেনি।
কিভাবে খুন করা হয় এবং দেহ লোপাট
জিহাদ স্বীকার করে যে প্রথমে আজিমকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয় । এরপর তার দেহ মাংস কুচি কুচি করে কাটা হয় , হাড় গুলোকে টুকরো টুকরো করা হয়। ওই টুকরো টুকরো মাংস হলুদ মাখিয়ে পলি প্যাকে করে নিয়ে যায় তারা এবং শহরের যত্রতত্র ফেলে দেয় বলে দাবি পুলিশের। বাংলাদেশের গোয়েন্দা প্রধান কলকাতা সিআইডিকে অনুরোধ করেন দেহাংশ খুঁজতে, যা স্থানীয় নিকাশী নালা ও সেপটিক ট্যাংকের পরীক্ষা করে বের করা হয়। প্রায় ৪ কেজি ওজনের মাংস ওই আবাসনের সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার হয় । খুনের পর দেহ আশি টুকরো করে ভাঙ্গরের জলাশয় ফেলা হয়েছে বলে ধৃত বলেন, কিন্তু সেখান থেকে এখনো পর্যন্ত কিছু উদ্ধার হয়নি।
খুনের পরিকল্পনা
খুনের পরিকল্পনা দীর্ঘ দিনের। এই পরিকল্পনা কার্যকর করতে নিউটাউনের আবাসনটি প্রায় লক্ষাধিক টাকার বিনিময়ে ভাড়া নেয় সাংসদের দীর্ঘদিনের বন্ধু ও ব্যবসায়ী সহযোগী শাহীন । সাংসদকে খুনের আগেই শাহীন কলকাতা ছেড়ে ঢাকা হয়ে অন্য কোন দেশে চলে যায়, পুলিশ সূত্রে দাবি । ৩০ এপ্রিল আমানুল্লা ও শিলাস্তিকে নিয়ে কলকাতায় আসেন শাহীন এবং তারা নিউমার্কেটে কোন এক হোটেলে উঠেছিল। জিহাদ খুলনার লোক , তবে সে বেআইনিভাবে মুম্বাইয়ে থাকে। সিআইডি সূত্রে খবর খুনের পরের দিন ১৪ ই মে প্রথমে আবাসন থেকে বার হয় জিহাদ এবং সিয়াম ,পরের দিন আমানুল্লাহ ও শিলাস্তিকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। ১৮ই মে ফয়সাল এবং মোস্তাফিজুর ওই আবাসন ছাড়েন । জিহাদ এবং সিয়াম বেআইনিভাবে সীমান্ত পেরিয়ে যাতায়াত করত। প্রধান খুনী আমান “খুলনার এাস”ফেরা সন্ত্রাসী নেতা শিমুল ভূঁইয়ার সাথে শাহিনের ৫ কোটি টাকার চুক্তি হয় সাংসদ কে খুন করে দেহ লোপাট জন্য, পুলিশ সূত্রে খবর।
বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম অনার কলকাতায় মৃত্যুর ঘটনা একটি হৃদয়বিদারক এবং জটিল রহস্যে পরিণত হয়েছে। দুই দেশের পুলিশ এবং গোয়েন্দা বিভাগের সমন্বিত প্রচেষ্টায় তদন্ত এগিয়ে চলছে, এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সকলেই চেষ্টা করছে।