ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ভূ-কৌশলগত বিষয় জটিল এবং গভীর। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল কে যুক্ত করার জন্য একটি ট্রেন পরিষেবা চালুর পরিকল্পনা করেছে। যা উভয় দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এছাড়া বাংলাদেশ নেপাল এবং ভুটানের সাথে খুব সহজেই যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করতে সক্ষম হবে।
২০১০ সালে ট্রানজিট চুক্তি সই হয়, সেখানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, ভারতকে ট্রানজিট ফ্রি হিসাবে প্রতি টনে ৩০০ টাকা দিতে হবে। নেপাল ও ভুটানের সাথেও ১৯৭৬ এবং ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের সাথে ট্রানজিট চুক্তি হয় মালবাহী ট্রেন চলাচলের জন্য তবে তা বাস্তবায়িত হয়নি।
পণ্যবাহী একটি যানবাহন থেকে পণ্য আরেকটি যানবাহনে স্থানান্তর করে পরবর্তী গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে ট্রান্স-শিপমেন্ট বলে। যেমন- ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশের বেনাপোল স্থলবন্দরে ঢুকে ট্রাক পরিবর্তন করে, বাংলাদেশের ট্রাকে করে আবার ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষা আখাউড়া স্থলবন্দরে গিয়ে পণ্য নামিয়ে দেওয়া হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে ট্রান্স-শিপমেন্ট বলে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের এই চুক্তি কার্যকর হয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ, ভারতের স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানের ট্রানজিট পণ্য রপ্তানি সুবিধা পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। এছাড়া বাংলাদেশ ভুটান ভারত ও নেপালের মধ্যে অবাধে গাড়ি চলাচলের জন্য ২০১৫ সালে ‘বিবিআইএন’ চুক্তি হয়।
বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে রেল ট্রানজিটের নতুন চুক্তি হয় ।সেই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের ট্রেন ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানে যেতে পারবে। তেমনি ভারতের ট্রেন বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যাবে তাতে বাংলাদেশের রোড গুলির লাভ হবে এবং ভারত ছাড়া নেপাল ভুটানের সাথে যোগাযোগ ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে আরো উন্নতি ঘটবে। শিলিগুড়ির করিডোর থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে ট্রেন চলাচল হবে যার ফলে ১৪ টি নতুন রূট তৈরি হবে, সেই স্যাংশন করা ট্র্যাকের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২৭৫.৫ কিলোমিটার।
ভারতের যে গ্রীড লাইন আছে সেই গ্রিডের ট্রান্সমিশন লাইন দিয়ে নেপাল থেকে চল্লিশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করবে বাংলাদেশ। যখন বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকবে (শীতের মরসুমে) তখন তারাও বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে পারবে ভারতকে। এছাড়াও ভারতে গ্যাস ব্যবহার করে ত্রিপুরা রাজ্যে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় , পালাটানা প্রজেক্ট এর মাধ্যমে অত্যন্ত কম খরচে বাংলাদেশ সেই বিদ্যুৎ আমদানি করে। বাংলাদেশে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় তা ড্রিজেল বা অন্যান্য জ্বালানি নির্ভর যা অত্যন্ত খরচাসাপেক্ষ। এই খরচের থেকেও কম খরচে বিদ্যুৎ আনা হয় ভারত থেকে কারণ সেটি গ্যাসভিত্তিক।
বাংলাদেশের রেলপথ অনেক পুরানো এবং রক্ষণাবেক্ষণ এর অভাবে যা আরো ক্ষতিগ্রস্ত। বিভিন্ন রূটের অবস্থার অবনতি হওয়ায় ট্রেনের গতি সীমিত, রেল স্টেশন গুলি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, প্রায়শই যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ ট্রেন যেহেতু ড্রিজেল চালিত, তাই তা খরচাসাপেক্ষ। পর্যাপ্ত পরিমাণ ট্রেন তাদের কাছে মজুদ না থাকায় যাত্রীদের ভিড় চোখে পড়ার, মতো তাতে যাত্রীদের জীবনহীন সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। ইলেক্ট্রিফিকেশন এর কাজ কিছু অংশ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে রেল চলাচল শুরু হলে নতুন ট্র্যাক নির্মাণ এবং পুরনো ট্র্যাকগুলি সংস্কারের সম্ভাবনাও রয়েছে। এছাড়া ট্রানজিট ফ্রি এর সাথে, রেলপথ ব্যবহারের মাধ্যমে কাস্টমস এবং অন্যান্য পরিষেবার মাধ্যমে আর্থিক আয় বৃদ্ধি পাবে। রেল নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন যা নতুন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশটির কিছুটা বেকারত্ব সমস্যা কমাবে। ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর সাথে ও তার অবস্থান মজবুত করতে পারবে।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে, এই সমস্ত চুক্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিভিন্ন দিক দিয়ে আরো উন্নয়নের পথে এগোবে। বাংলাদেশে বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে, নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সামাজিক উন্নয়ন প্রমুখ ঘটবে। সামাজিক উন্নয়নের ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য সামাজিক খাতে উন্নয়ন ঘটবে নতুন রেলপথ ব্যবস্থার মাধ্যমে। দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চল গুলিতে শিক্ষার প্রসার এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন সম্ভব হবে। বাংলাদেশের রেলপথ এবং পরিবহন ব্যবস্থা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পথে যে সমস্ত বাধার সম্মুখীন হচ্ছে তার মোকাবিলা করে উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।