ছৌ নাচ হলো ভারতের পূর্বাঞ্চলের একটি বর্ণাঢ্য ও ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য, যা পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্যে বিশেষভাবে প্রচলিত। ছৌ নাচের তিনটি প্রধান ধারা রয়েছে—পুরুলিয়া ছৌ, ময়ুরভঞ্জ ছৌ, এবং সেরাইকেল্লা ছৌ। প্রতিটি ধারার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, অভিনবত্ব এবং শৈলী রয়েছে, যা এই নাচকে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।
*পুরুলিয়া ছৌ: অবস্থান ও প্রেক্ষাপট:*
পুরুলিয়া ছৌ নাচ পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলায় প্রচলিত। এটি ছৌ নাচের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারা এবং বাঙালি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
*বৈশিষ্ট্য:*
পুরুলিয়া ছৌ নাচে মুখোশ পরিধান করা হয়, যা এই নাচের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই নাচে মূলত মহাকাব্য রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণ থেকে গল্প নেওয়া হয়। নৃত্যশৈলী বেশ আক্রমণাত্মক এবং শক্তিশালী, যেখানে বীরত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু এবং যুদ্ধের দৃশ্য মঞ্চস্থ করা হয়। পুরুলিয়া ছৌ নাচে শারীরিক ক্ষমতা এবং নমনীয়তার প্রদর্শন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা এই নাচকে শক্তিশালী ও জীবন্ত করে তোলে।
*সঙ্গীত:*
পুরুলিয়া ছৌ নাচের সঙ্গে ঢোল, শিঙা, শানাই এবং ধামসা বাজানো হয়। এই বাদ্যযন্ত্রগুলোর সংমিশ্রণে সৃষ্ট ছন্দ নাচের শক্তিশালী ও আক্রমণাত্মক স্বভাবের সঙ্গে মানানসই হয়।
*ময়ুরভঞ্জ ছৌ: *অবস্থান ও প্রেক্ষাপট:*
ময়ুরভঞ্জ ছৌ নাচ ওডিশা রাজ্যের ময়ুরভঞ্জ জেলায় প্রচলিত। এটি ছৌ নাচের সবচেয়ে প্রাচীন ধারা হিসেবে বিবেচিত।
*বৈশিষ্ট্য:*
ময়ুরভঞ্জ ছৌ নাচে মুখোশ ব্যবহার করা হয় না, যা একে অন্য ধারাগুলোর থেকে পৃথক করে। এই নাচের কোরিওগ্রাফি অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং শৈল্পিক। এখানে নৃত্যশিল্পীরা মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি এবং শারীরিক ভঙ্গিমার মাধ্যমে কাহিনী তুলে ধরেন। ময়ুরভঞ্জ ছৌ নাচে যুদ্ধের দৃশ্য এবং পৌরাণিক কাহিনীগুলোর পাশাপাশি সামাজিক এবং প্রাকৃতিক ঘটনা নিয়েও নৃত্য পরিবেশন করা হয়।
*সঙ্গীত:*
ময়ুরভঞ্জ ছৌ নাচের সঙ্গীতে মৃদঙ্গ, শিঙা, নাগারা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। মৃদঙ্গের নরম সুর এবং নাগারার তীব্র ছন্দ এই নাচের কাহিনীকে জীবন্ত করে তোলে।
*সেরাইকেল্লা ছৌ: *অবস্থান ও প্রেক্ষাপট:*
সেরাইকেল্লা ছৌ নাচ ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সেরাইকেল্লা-খারসাওয়ান জেলায় প্রচলিত। এটি ছৌ নাচের সবচেয়ে শৈল্পিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ধারা।
*বৈশিষ্ট্য:*
সেরাইকেল্লা ছৌ নাচে মুখোশ ব্যবহার করা হয় এবং এই মুখোশগুলো অত্যন্ত শিল্পসমৃদ্ধ। নৃত্যশিল্পীরা মুখোশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শরীরের ভাষা এবং মুদ্রার মাধ্যমে কাহিনী তুলে ধরেন। এই নাচে মহাকাব্য ও পৌরাণিক কাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় কিংবদন্তি এবং সামাজিক কাহিনীও মঞ্চস্থ করা হয়। সেরাইকেল্লা ছৌ নাচের শৈলী অনেকটাই নরম, সূক্ষ্ম এবং শৈল্পিক, যা একে অন্যান্য ছৌ ধারার থেকে আলাদা করে।
*সঙ্গীত:*
সেরাইকেল্লা ছৌ নাচে মৃদঙ্গ, ঢোল এবং শিঙার পাশাপাশি বাঁশির ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। এই বাদ্যযন্ত্রগুলোর মেলবন্ধন নাচের শৈল্পিক গাম্ভীর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
*উপসংহার:*
ছৌ নাচের এই তিনটি ধারা, পুরুলিয়া, ময়ুরভঞ্জ, এবং সেরাইকেল্লা, বাংলার এবং ভারতের লোকসংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। প্রতিটি ধারার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, সঙ্গীত এবং কাহিনীর মাধ্যমে তারা সমৃদ্ধ করে চলেছে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। যদিও আধুনিক সমাজে ছৌ নাচের প্রচলন কিছুটা কমে এসেছে, তবে এখনো এই নাচের চর্চা এবং সংরক্ষণ অব্যাহত রয়েছে, যা আমাদের ঐতিহ্যকে জীবিত রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।