শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে হবে বিচারের জন্য। অনেকটা হুংকারের সুরেই এমন বার্তা দিয়েছেন, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম মেহবুব উদ্দিন খোকন। উল্লেখ্য, চলতি বছরের মার্চেই আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে তিনি সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরেই, দেশের অভ্যন্তরীণ সমীকরণ যেমন বদলেছে, তেমন ভারতীয় উপমহাদেশে কতগুলি জটিল প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি দেখা দিয়েছে, মাত্র চার দিনে এমন কী খেলা হল, যার জন্য হাসিনার পায়ের তলা থেকে জমি সরে গেল অথচ তিনি আঁচও করতে পারলেন না?
অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী ডঃ মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে তদারকী সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেই গঠন করা হচ্ছে তদারকী সরকারের সদস্যদের নাম। এই কর্মকাণ্ডে গুরু দায়িত্বে দেখা গিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে। তিনিও ছাত্রছাত্রীদের পাশে থেকে আশা প্রকাশ করেছেন,তদারকী সরকারের হাত ধরেই আগামী দিনে বাংলাদেশে নতুন নির্বাচন হবে এবং এক গণতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব হবে।
তদারকী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নাম ঘোষণার পরেই কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ডঃ মহম্মদ ইউনুস। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বার্তা দিয়েছেন, ভারত প্রতিবেশী দেশ এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমমর্যাদার সঙ্গে কাজ করতে চান। পাশাপাশি তিনি কিঞ্চিত আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, বাংলাদেশে অস্থীতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে, তার প্রভাব, পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতেও পড়বে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সরকার না থাকায়, এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলছে, অবিলম্বে একটি সরকার গঠন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সেই দিকে তাকিয়ে রয়েছে ভারতও। কিন্তু দিল্লির কাছে কাঁটা হয়ে উঠছে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে একটি ন্যারেটিভ সবচেয়ে জোরালো হয়ে দেখা দেয়, সেটি হল, নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে ভারত। এমনকী ২০২৪ সালের নির্বাচনেও এই বক্তব্য ভেসে ওঠে। যদিও ভারত স্পষ্টভাবে বার্তা দিয়েছিল, নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, এখানে দিল্লির কিছু করণীয় নেই। দিল্লি যাই বলুক, বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে বিরোধীদের তোলা বক্তব্যই ক্রমশ বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দুটি শক্তি ময়দানে না থাকায় কার্যত ফাঁকা মাঠেই গোল দেয় আওয়ামী লীগ। আর এই কর্মকাণ্ডের পিছনে পুরোপুরি ভারতের হাত রয়েছে, এমনই অভিযোগ তোলা হয়েছিল।
মাত্র সাত মাসের মধ্যেই পরিস্থিতি আচমকাই যেন বিগড়ে গেল। শুধু বাংলাদেশেই নয়, অঙ্ক ক্রমশ জটিল হতে শুরু করল ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের। ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেনের অন্যতম প্রধান মুখ ডাঃ পিনাকী ভট্টাচার্য সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যে দেশ শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেবে, সেই দেশকে শত্রু মনে করবেন তাঁরা। তাঁদের বার্তা, শেখ হাসিনাসহ, তার সাগরেদদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার চালাতে হবে। এই দাবি, জামাত বা বিএনপির তরফে এখনও সেভাবে জোরালো ভাবে না উঠলেও, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতি মেহবুব উদ্দিন খোকনের বার্তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
সংবাদমাধ্যমগুলির রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমনকি ইউনাইটেড কিংডমে আশ্রয় নেওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন হাসিনা। কিন্তু দুই দেশই সেই আবেদন খারিজ করেছে। এখানেই একটা প্রশ্ন জোরালো হয়ে দেখা দিচ্ছে , এবার তাহলে কোথায় যাবেন শেখ হাসিনা? কোনও দেশ যদি হাসিনাকে আশ্রয় দিতে রাজি না হয়, তাহলে কি ভারতেই থাকবেন? ঘটনা হল, হাসিনা স্বল্প মেয়াদের জন্য ভারতে থাকার আবেদন জানিয়েছিলেন, কিন্তু পরিস্থিতি যদি যটিল হয়, তাহলে তাঁকে ভারতেই রাখতে হবে। কূটনৈতিক মহলের একটা অংশ মনে করছে, বর্তমানে বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, ভারত বিরোধী জনমত এখনও যেভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে, সেখানে শেখ হাসিনাকে দীর্ঘমেয়াদী ভাবে ভারতে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ হবে। বাংলাদেশে নতুন যারা ক্ষমতায় আসবে, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে হাসিনা। তাহলে? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয়, ঢাকার চাপ কমাতে হাসিনাকে যদি অন্য দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করেও দেওয়া হয়, তাহলে কি শতবর্ষ প্রচীন ভারত বিরোধী তত্ত্ব এক লহমায় মুছে যাবে? নাকি এটা ভেবেই তারা আরও বেশি শক্তিশালী হবে, তাদের চাপেই মাথা নত করে দিল্লি হাসিনাকে দ্রুত বিদায় জানাতে পদক্ষেপ করেছে।
না রাজনীতির চিত্রনাট্য এখানেই শেষ নয়, বরং এর উল্টোপীঠও রয়েছে, হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে এক ঢিলে তিনটি পাখি মারতে পারে দিল্লি। এমনও তত্ত্ব উঠে আসছে কূটনৈতিকমহলে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশে এই নির্বাচিত (বিতর্ক রয়েছে) সরকারকে ফেলতে বড় খেলা খেলেছে আমেরিকা। আর একটি তত্ত্ব রয়েছে, এই খেলাতে সঙ্গত দিয়েছে চীন এবং পাকিস্তানের আইএসআই। এই পরিস্থিতিতে হাসিনার পাশে থাকা দিল্লির কাছে অগ্নিপরীক্ষার মতো। চীনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই, দলাই লামাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। তিনি এখনও শুধু ভারতে আছেন তাই নয়, এই একটি কারণে চীন এখনও কূটনৈতিক দিকে দিল্লির কাছে কিছুটা চাপে আছে।
কূটনৈতিক চাপে না পড়ে দিল্লির ভাবা উচিত, সাময়িক উঠে আসা সঙ্কটে নড়বড়ে সিদ্ধান্ত না নিয়ে বরং সমস্যার মধ্যেই সমাধানের পথ খোঁজার। হাসিনাকে যদি ভারত দীর্ঘ মেয়াদী আশ্রয় দেয়, সেটা হবে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বড় গেম চেঞ্জার। আমেরিকাসহ পশ্চিমী দেশগুলিকে বার্তা দেওয়া যাবে, তাদের তৈরি করা সঙ্কটে ভীত নয় ভারত। পাশাপাশি ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির ক্ষেত্রেও বার্তা যাবে, যখনই কোনও দেশ সঙ্কটে পড়বে, তাদের জন্য সংকটমোচন হয়ে দাঁড়াবে ভারত। হাসিনার দুঃসময়ে যেভাবে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য নিজেদের রং বদলে নিয়েছে, কঠিন পরিস্থিতিতে ভারত কিন্তু সেই রং বদলায়নি।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পরেই, জামাত-শিবির, দুষ্কৃতীদের দাপটে, পুরোপুরি কোনঠাসা হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা লাগামছাড়া অত্যাচার চালানো হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের উপর নির্মম আঘাত হানা হচ্ছে। সেই অবস্থাতেও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এই অবস্থায় শেখ হাসিনাকে ভারতে রেখেই পাল্টা একটা কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা যেতে পারে। যাতে আগামী দিনে বাংলাদেশে একটি নিরপেক্ষ সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রূপদান করা যায়।
মনে রাখতে হবে, সময় ধারাবাহিকভাবে একই খাতে বয়ে চলে এমন ইতিহাস কোথাও নেই। বর্তমানে কঠিন পরিস্থিতি আছে, তা সময়ের সঙ্গে চলেও যাবে। কিন্তু বিশ্বের কাছে বার্তা দেওয়াটা জরুরি, ভারত মেরুদণ্ডহীন দেশ নয়।